লেখকঃ ডা. শাহনাজ পারভীন জেবা-সহকারী অধ্যাপকঃ গাইনেকোলজি বিভাগ।
প্রসবকালীন ব্যথা ২০টি হাড়ভাঙা ব্যথার সমান। যা পৃথিবীর কষ্টকর ব্যথাগুলোর একটি। প্রসবব্যথার সঙ্গে আর কোনো ব্যথার তুলনা করা যায় না। তাই এই ব্যথার ভয়ে অনেকেই স্বাভাবিক প্রসব (নরমাল ডেলিভারি) এড়িয়ে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করাতে চান।
সিজারিয়ান অপারেশন বনাম ব্যথামুক্ত প্রসব
-সিজারিয়ান অপারেশন একটি অস্ত্রোপচার, তাই অস্ত্রোপচারকালীন অথবা এর পরে অনেক জটিলতা ঘটতে পারে। স্বাভাবিক বা ব্যথামুক্ত প্রসবে এটা হয় না।
-সিজারিয়ান অপারেশনে একজন মায়ের দুই বা তিনের বেশি গর্ভধারণ করা সম্ভব নয়। স্বাভাবিক বা ব্যথামুক্ত প্রসবে এটা সম্ভব।
-সিজারিয়ান অপারেশনে ইন্সিসনাল হার্নিয়া বা তলপেটের ব্যথা বা অন্যান্য জটিলতা হতে পারে। স্বাভাবিক বা ব্যথামুক্ত প্রসবে এটা হয় না।
-সিজারিয়ান অপারেশনে কাটা জায়গা বা ছিঁড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্বাভাবিক বা ব্যথামুক্ত প্রসবে এটা হয় না।
-একবার সিজারিয়ান অপারেশন হলে পরবর্তী স্বাভাবিক প্রসবেও এই দিকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কাজেই প্রথম থেকে আমাদের উচিত অহেতুক সিজারিয়ান অপারেশনে না যাওয়া।
-সিজারিয়ান সেকশনে অস্ত্রোপচার–পরবর্তী হাসপাতালে কয়েক দিন থাকতে হয়। কিন্তু ব্যথামুক্ত প্রসবে সন্তান হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন মা বাসায় চলে যেতে পারেন।
ব্যথামুক্ত নিরাপদ প্রসব
বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞানের যুগে ব্যথামুক্ত প্রসব খুব কঠিন বিষয় নয়। অস্ত্রোপচার না করেও সহজভাবে ব্যথামুক্ত প্রসব সম্ভব। উন্নত দেশে নিয়মিত ব্যথামুক্ত প্রসব করানো হয়ে থাকে।
এ পদ্ধতিতে সাধারণত মেরুদণ্ডে কিছু ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে (যেভাবে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার করা হয়) প্রসব চলাকালীন মাকে ব্যথামুক্ত রাখা হয়। এতে স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটারের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ সময় প্রসবকালীন সম্পূর্ণ ব্যথামুক্ত থেকে মা কথা বলতে পারেন, হালকা খাবার খেতে পারেন এবং হাসতে হাসতে সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে পারেন।
ব্যথামুক্ত স্বাভাবিক প্রসবের জন্য দরকার একটি অত্যাধুনিক প্রি-ডেলিভারি, ডেলিভারি এবং পোস্ট–ডেলিভারি ব্যবস্থা। এর সঙ্গে থাকা দরকার একটি সিনক্রোনাইজড অভিজ্ঞ লেবার এবং অ্যানেসথেসিয়া টিম। প্রি-ডেলিভারি বা প্রাক্–প্রসব কক্ষে থাকতে হবে অত্যাধুনিক মনিটরিং ব্যবস্থা এবং সহায়ক সব যন্ত্রপাতি, যাতে মা বা নবজাতকের কোনো ধরনের সমস্যা হলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। জুনিয়র ডাক্তার ও স্পেশালিস্ট সার্বক্ষণিকভাবে এই ডেলিভারি কমপ্লেক্সে থাকতে হবে এবং পরামর্শক চিকিৎসককে বারবার গর্ভবতী মাকে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। এই ব্যবস্থা রাতদিন ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় থাকতে হবে। এখানে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া যদি কোনো ক্ষেত্রে সিজারিয়ান অপারেশন করার দরকার হয়ে পড়ে অথবা কোনো জটিলতা দেখা দেয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে প্রসূতি মায়ের অস্ত্রোপচার করানোর জন্য অপারেশন থিয়েটার এবং অপারেশন থিয়েটারের সঙ্গে সম্পৃক্ত জনবলকেও প্রস্তুত থাকতে হবে। নবজাতককে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য বাচ্চাদের ওয়ার্ড এবং বাচ্চাদের আইসিইউ (এনআইসিইউ) অবশ্যই কার্যকরী অবস্থায় থাকতে হবে। সিস্টেমটা জটিল ও ডিমান্ডিং। তাই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার সময় দেওয়ার মানসিকতা ও পারদর্শিতা দরকার। বিকল্প ক্ষেত্রে যদি আমরা সিজারিয়ান অপারেশনে চলে যাই, তাহলে আমাদের এই বৃহৎ জনশক্তি এবং অবকাঠামোর সামান্যই প্রয়োজন পড়ে।
কথা উঠতে পারে, আমাদের গ্রামেগঞ্জে তো বেশির ভাগ জায়গায় ধাত্রীরাই এই প্রসব পরিচালনা করে থাকেন। কিন্তু সেখানে সমস্যা হলো, কোনো জটিলতা হলে তা মায়ের ক্ষতি, বাচ্চার ক্ষতি অথবা উভয়েরই ক্ষতির পর্যায়ে গড়ায়, যা আমাদের মতো সমাজে গ্রহণ করা যায় না। সে জন্যই এ বিশাল কর্মযজ্ঞ এবং এ জন্যই নরমাল ডেলিভারির প্রতি প্রসূতি মা ছাড়া সবারই একটা অনীহা।
আমরা এর সঙ্গে যুক্ত করেছি ব্যথামুক্ত ডেলিভারি। অনেকে বলতে পারেন, ব্যথার ওষুধ দেওয়ার ফলে কোনো সমস্যা কি হতে পারে? যে সিস্টেমে ওষুধটা দেওয়া হয়, সেটাকে আমরা বলি এপিডিউরাল অ্যানেসথেসিয়া। এখানে মেরুদণ্ডের ভেতরে ছোট একটি ক্যাথেটার ঢুকিয়ে ব্যথার ওষুধ দেওয়া হয়। এটা আমাদের দেশে সিজারিয়ান অপারেশনের সময় যে স্পাইনাল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়, তার খুব কাছাকাছি, কিন্তু কিছু বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার হয়। যত ভালোভাবে এপিডিউরাল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া যাবে, তত এর থেকে উদ্ভূত জটিলতা কম হবে। সত্যি কথা বলতে কি, যারা এপিডিউরাল অ্যানেসথেসিয়া দিতে অভিজ্ঞ, তাঁদের ক্ষেত্রে লো-ব্যাক পেইন বা ছোটখাটো দু-একটি সমস্যা ছাড়া জটিল কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সব প্রসূতি মায়ের ক্ষেত্রে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এই ব্যথামুক্ত নরমাল ডেলিভারি করা হয়ে থাকে। সেখানে সিজারিয়ান অপারেশনের মাত্রা সাধারণত ১০ শতাংশের নিচে। কিছু কিছু কারণে যা বেশির ভাগই অনভিপ্রেত, আমাদের দেশে, বিশেষ করে ঢাকা শহরের আশপাশে সিজারিয়ান অপারেশনের সংখ্যা ২৮ শতাংশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি। আজকাল অনেক মা ডেলিভারির সময় ব্যথা সহ্য করতে চান না। এই ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমাদের দেশে ৫০ শতাংশ সিজারিয়ান অপারেশন হয়ে থাকে। সুস্থভাবে জন্ম হোক সব সন্তানের। ভালো থাকুক, নিরাপদে থাকুক মায়েরা।
লেখক: কুমিলা সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনোকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহনাজ পারভীন জেবা।